০৫:১৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৯ মে ২০২৫
অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ইমানি দায়িত্ব

অন্যায় বা অপরাধীকে যারা সমর্থন করে পরকালে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা

  • রিপোর্টার
  • Update Time : ০৬:১৭:৫১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫
  • ১৬ Time View

হাফেজ মাওলানা আনোয়ার হোসেন :বর্তমান সমাজে বেশ কিছু মানুষের দেখা মেলে, যাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয় অন্যায় করায় কোন দোষ নাই, কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ করা মহাদোষ। এরা সর্বদা অন্যায়কারীর পক্ষে কথা বলে এবং অন্যায়ের প্রতিবাদকারীর বিভিন্ন দোষত্রুটি ধরে হেয় করার চেষ্টায় থাকে। কেউ কোন অন্যায় করলে তার প্রতিবাদ করার মত সাহসী লোক এখন তেমন একটা পাওয়া যায় না। ফলে অন্যায় ক্রমবর্ধমানহারে বেড়েই চলছে। অপরদিকে অন্যায়ের প্রতিবাদকারীর সংখ্যা অনেক কমে যাচ্ছে। সমাজে এখন প্রকাশ্যে অসংখ্য অন্যায়কাজ সংঘটিত হচ্ছে কিন্ত এসব অন্যায়কাজে বাঁধা দেয়ার মত লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দুনিয়া আখিরাত উভয় জগতেই এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। রাসুলুল্লাহ (সা) অসংখ্য হাদীসে এ ব্যাপারে সকলকে সতর্ক করেছেন।

প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতকে যেসব কারণে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে তার অন্যতম একটি হলো অন্যায়ের প্রতিবাদ। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, মানুষের কল্যাণেই তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অন্যায় কাজে বাধা প্রদান করবে।’ (সূরা আল ইমরান, (৪), আয়াত, ১১০) 

আল্লাহ তায়ালা অন্যায়ের প্রতিবাদকে মুসলিম জাতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করেছেন। যেকোনো অন্যায়ের সামনে নীরব ভূমিকা ইসলাম কখনোই সমর্থন করে না, বরং নিজ সাধ্য ও সামর্থ্যরে আলোকে এসব অন্যায়-অপরাধের প্রতিবাদ করা এবং তা নির্মূলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা ঈমান ও ইসলামের অপরিহার্য দাবি।

আবু সায়িদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোনো অন্যায় হতে দেখলে যেন হাত দিয়ে তা প্রতিহত করে। যদি তা না পারে, তবে কথা দিয়ে; তাও না পারলে অন্তর দিয়ে (ঘৃণা করবে)। এটি ঈমানের দুর্বলতম স্তর।’ (মুসলিম, হাদিস, ৭৪)

আরেক হাদিসে হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যার হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ করে বলছি, ‘তোমরা অবশ্যই ভালো কাজে মানুষকে আদেশ দেবে এবং অবশ্যই অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। যদি তা না করো তা হলে আল্লাহ তোমাদের ওপর তার পক্ষ থেকে শাস্তি প্রেরণ করবেন। এরপর তোমরা তার নিকট প্রার্থনা করলেও তিনি কবুল করবেন না’ (তিরমিজি, হাদিস, ৪০৬)।

অন্যায় ও অত্যাচারের প্রতিবাদ না করলে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ধ্বংস অনিবার্য। এক হাদিসে নুমান ইবনে বাশির রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যারা মহান আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং যারা সীমা লঙ্ঘন করে, তাদের দৃষ্টান্ত সেই যাত্রীদলের মতো, যারা লটারির মাধ্যমে দ্বিতল বিশিষ্ট এক জাহাজে নিজেদের স্থান নির্ধারণ করে নিল। তাদের কেউ স্থান পেল ওপর তলায় আর কেউ নিচ তলায়। আর পানির ব্যবস্থা ছিল ওপর তলায়। কাজেই নিচের তলার লোকেরা পানি সংগ্রহকালে ওপর তলার লোকদের ডিঙিয়ে যেত। তখন নিচ তলার লোকেরা বলল, ওপর তলার লোকদের কষ্ট না দিয়ে আমরা যদি নিজেদের অংশে একটি ছিদ্র করে নিই তবে ভালো হয়। এমতাবস্থায় ওপর তলার লোকেরা যদি তাদের আপন মর্জির ওপর ছেড়ে দেয় তা হলে সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যদি তারা এদের হাত ধরে রাখে (বিরত রাখে) তবে তারা এবং সবাই রক্ষা পাবে।’ (বুখারি, হাদিস, ২৪৯৩)

যারা অন্যায় দেখেও তার প্রতিহত করার কোন চেষ্টা ফিকির করে না তারা কালিমায়ে তাওহীদের হকের অবমাননা করে। তারা সারা জীবন এ কালিমা পাঠ করলেও তা তাদেরকে আল্লাহর আজাব থেকে বাঁচাতে যথেষ্ঠ হবে না। হযরত আনাস (রা) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, কালিমায়ে তাওহীদ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তার পাঠকারীকে সর্বদা উপকার করতে থাকে এবং তার উপর হতে আজাব ও বালা-মুসিবত দুর করতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত এর হকের অবমাননা না করা হয়। সাহাবীগণ (রা) জিজ্ঞাসা করলেন, কালিমায়ে তাওহীদের হকের অবমাননা করার অর্থ কি? রাসুলুল্লাহ (সা) বললেন, প্রকাশ্যে আল্লাহর নাফরমানী করা হয় আর তা বন্ধ করার জন্য কোন চেষ্টা করা হয় না। (তারগীব)

অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যারা অন্যায় কাজে বাঁধা দেয় না তাদের জন্য পরকালের কঠিন শাস্তি ছাড়াও এ দুনিয়াতেও আল্লাহর আজাবে পাকড়াও হবে এ সম্পর্কে হযরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, যদি কোন কোন কওমের মধ্যে কোন ব্যক্তি কোন গোনাহের কাজে লিপ্ত হয় এবং ঐ কওমের মধ্যে শক্তি থাকা সত্ত্বেও তাকে উক্ত গোনাহ থেকে বাঁধা না দেয় তবে মৃত্যুর পুর্বে দুনিয়াতেই তাদের উপর আল্লাহর আজাব নাযিল হয়। (আবু দাউদ, ইবনে মাজা, ইবনে হিব্বান।)

অন্যায়ের প্রতিবাদ না করার ফলে যখন শাস্তি নাযিল হবে তখন দোয়া করলেও সে শাস্তি থেকে বাঁচার কোন পথ নেই। এ সম্পর্কে হযরত হুযাইফা (রা) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যার হাতে আমার প্রাণ তার কসম করে বলছি, তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজে বাধা দিবে। তা না হলে অচিরেই আল্লাহর পক্ষ হতে তোমাদের ওপর কঠিন শাস্তি নেমে আসবে। তখন তোমরা (সে শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য) দোয়া করবে, কিন্তু আল্লাহ তোমাদের দোয়া কবুল করবেন না। (তিরমিযী)

প্রকৃতপক্ষে চুরি করার সময় চোরের মাঝে তার ঈমানী শক্তি থাকে না। যার কারণে পাপ সত্তে¡ও একজন চোর তার চুরির কাজ সম্পন্ন করে। হাদিসে এ সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, যিনাকারী যখন যিনা করে তখন আর সে ঈমানদার থাকে না। চোর যখন চুরি করে তখন সে ঈমানদার থাকে না। মদ্যপ যখন মদ পান করে তখন তার আর ঈমান থাকে না। যখন ডাকাত এভাবে ডাকাতি করে যে, যখন চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে তখন তার ঈমান থাকে না। এভাবে কেউ যখন গনিমতের সম্পদ খেয়ানত করে, তখন তার ঈমান থাকে না। অতএব সাবধান (এসব গুনাহ হতে দূরে থাকবে)।’ (বুখারি : ২৪৭৫; মুসলিম: ৫৭; আবু দাউদ : ৪৬৮৯; নাসায়ি : ৪৮৭০; তিরমিজি : ২৬২৫; ইবনে মাজাহ : ৩৯৩৬)

প্রিয় নবী (সা.) চোরকে বা চুরিকে কখনও প্রশ্রয় দেননি। চোরকে শরিয়ত মোতাবেক শাস্তি প্রদান করেছেন। মহান রাব্বুল আলামিন চুরির শাস্তি পবিত্র কোরআনে আলোকপাত করেছেন। আল্লাহর বাণীÑ ‘তোমরা পুরুষ চোর এবং মহিলা চোর উভয়ের হাত কেটে দাও। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের কৃতকর্মের শাস্তি স্বরূপ।’ (সুরা মায়িদা : ৩৮)

রাসুল (সা.) অন্যের সম্পদকে লুট করে নেওয়া বা তাতে হস্তক্ষেপ করতে নিষেধ করেছেন। বিদায় হজের ভাষণে তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের রক্ত, সম্পদ ও সম্মানে হস্তক্ষেপ করা নিষিদ্ধ।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৬০১৯)। তাই চুরি করে হোক আর যেভাবেই হোক অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রহণ করা, ভোগ করা জায়েজ নয়।

ডাকাতি, ছিনতাই, লুট ইত্যাদি চুরি অপেক্ষা আরও গুরুতর অপরাধ। কেননা, চুরি হয় গোপনে, লোক চক্ষুর অন্তরালে। আর ডাকাতি, ছিনতাই, লুটপাট হয় প্রকাশ্যে, জনসমক্ষে বা অস্ত্র ঠেকিয়ে। এটি জঘন্যতম অপরাধ। যার কারণে আল্লাহ তায়ালা এর কঠিন শাস্তি নির্ধারণ করে রেখেছেন। আল্লাহর বাণী, ‘যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায়, তাদের শাস্তি এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে অথবা বিপরীত দিক হতে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে দেশ হতে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়াতে এটাই তাদের লাঞ্ছনা ও পরকালে তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে।’ (সুরা মায়িদা : ৩৩)। এই আয়াতে দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ানোর অর্থ কারও সম্পদ নিয়ে যাওয়া ও হত্যার মাধ্যমে অরাজকতা সৃষ্টি করা। এখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ডাকাতি, ছিনতাই ও অন্যভাবে বিপর্যয় সৃষ্টিকারীর জন্য সতর্কবাণী প্রদান করেছেন।

জাহিলদের দীনের অন্তর্ভুক্ত বিষয় হলো একজনের অপরাধে আরেকজনকে শাস্তি দেয়া। আল্লাহ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে বলেন,

وَلا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى

কোন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না (সূরা ফাতির ৩৫:১৮)।

…………………………………

ব্যাখ্যা: জাহিলী সমস্যা হলো তারা নিরপরাধকে পাঁকড়াও করতো অর্থাৎ অপরের অন্যায়ের কারণে তাকে শাস্তি দিতো। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে বলেন,

(وَلا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى) [فاطر: 18]

কোন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না (সূরা ফাতির ৩৫:১৮)।

সুতরাং যে অন্যায় করেনি তাকে অন্যের অপরাধের কারণে শাস্তি দেয়া যাবে না। যদিও সে অপরাধী ভাতিজা অথবা পিতা অথবা সন্তান হয়। অপরাধীকেই শাস্তি দেয়া হবে। নিরীহকে সীমালঙ্ঘনকারীর অপরাধের কারণে শাস্তি দেয়া যাবে না। সীমালঙ্ঘনকারীর অন্যায়ের কারণে নিরপরাধকে শাস্তি দেয়া হলে তা হবে যুলুম ও অত্যাচার যা ইসলাম স্বীকৃতি দেয় না।

বর্তমানে কতিপয় গ্রাম্যলোকের অবস্থা: অন্য গোত্রের কোন সাধারণ লোকের সাথে নিজ গোত্রের কারো দ্বন্দ্ব হলে গ্রাম্যলোকেরা ঐ সাধারণ লোকের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করে না। বরং তাদের গোত্রের অধিক মর্যাদা সম্পন্ন ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ হতে প্রতিশোধ গ্রহণ করে অথবা হত্যা করে। তারা সীমা লঙ্ঘনকারীকে শাস্তি দেয় না। বরং তারা কেবল গোত্রের সম্মানিত অথবা গ্রহণযোগ্য অথবা পদ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিকে শাস্তি দেয় যা জাহিলী কর্ম। অন্যায়ের অপরাধীকেই শাস্তির জন্য নির্দিষ্ট করা ওয়াজীব। তার নিকট থেকেই অপরাধের প্রতিশোধ নিতে হবে। এটাই ন্যায় বিচার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَمَنِ اعْتَدَى عَلَيْكُمْ فَاعْتَدُوا عَلَيْهِ بِمِثْلِ مَا اعْتَدَى عَلَيْكُمْ

সুতরাং যে তোমাদের উপর আক্রমণ করেছে, তোমরা তার উপর আক্রমণ কর, যেরূপ সে তোমাদের উপর আক্রমণ করেছে (সূরা আল-বাক্বারাহ ২:১৯৪)।

মোদ্দা কথা: সবচেয়ে বড় মূলনীতি হলো অপরাধীর সাথেই অপরাধকে নির্দিষ্ট করতে হবে, অন্যের সাথে নয়। যদি বলা হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা ভুলের ধার্য্যকৃত ক্ষতিপূরণ নিহতের রক্তমূল্য পরিশোধকারীর উপর নির্ধারণ করেছেন। হত্যাকারীর উপর নির্ধারণ করেননি। তাহলে এ ক্ষেত্রে অন্যের পাপ আরেকজন কি বহন করে না?

জবাবে বলা হবে, এটাই ন্যায় বিচার ও সত্যের সহযোগিতা। কেননা, এটা হত্যাকারীর অনিচ্ছাকৃত ভুল। এখানে ব্যক্তিকে সাহায্যে করাই যথাযথ। মানুষ মারা গেলে আত্মীয়-স্বজনরা যেমন মৃতের সম্পদের ওয়ারীস হয়, এটিও তেমনই। অনিচ্ছাকৃত যে ভুল হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ তার পক্ষ থেকে বহন করবে। অপর দিকে ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যায়কারীর উপরই তার অন্যায়ের শাস্তি বা ক্ষতিপূরণ বর্তাবে। একারণে ক্ষতিপূরণ করতে ইচ্ছুকের উপর তা বর্তাবে না।

 

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় নিউজ

শেখ হাসিনার অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে টিম গঠন করলো দুদক

অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ইমানি দায়িত্ব

অন্যায় বা অপরাধীকে যারা সমর্থন করে পরকালে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা

Update Time : ০৬:১৭:৫১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫

হাফেজ মাওলানা আনোয়ার হোসেন :বর্তমান সমাজে বেশ কিছু মানুষের দেখা মেলে, যাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয় অন্যায় করায় কোন দোষ নাই, কিন্তু অন্যায়ের প্রতিবাদ করা মহাদোষ। এরা সর্বদা অন্যায়কারীর পক্ষে কথা বলে এবং অন্যায়ের প্রতিবাদকারীর বিভিন্ন দোষত্রুটি ধরে হেয় করার চেষ্টায় থাকে। কেউ কোন অন্যায় করলে তার প্রতিবাদ করার মত সাহসী লোক এখন তেমন একটা পাওয়া যায় না। ফলে অন্যায় ক্রমবর্ধমানহারে বেড়েই চলছে। অপরদিকে অন্যায়ের প্রতিবাদকারীর সংখ্যা অনেক কমে যাচ্ছে। সমাজে এখন প্রকাশ্যে অসংখ্য অন্যায়কাজ সংঘটিত হচ্ছে কিন্ত এসব অন্যায়কাজে বাঁধা দেয়ার মত লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দুনিয়া আখিরাত উভয় জগতেই এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ। রাসুলুল্লাহ (সা) অসংখ্য হাদীসে এ ব্যাপারে সকলকে সতর্ক করেছেন।

প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতকে যেসব কারণে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে তার অন্যতম একটি হলো অন্যায়ের প্রতিবাদ। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘তোমরা শ্রেষ্ঠ জাতি, মানুষের কল্যাণেই তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অন্যায় কাজে বাধা প্রদান করবে।’ (সূরা আল ইমরান, (৪), আয়াত, ১১০) 

আল্লাহ তায়ালা অন্যায়ের প্রতিবাদকে মুসলিম জাতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে গণ্য করেছেন। যেকোনো অন্যায়ের সামনে নীরব ভূমিকা ইসলাম কখনোই সমর্থন করে না, বরং নিজ সাধ্য ও সামর্থ্যরে আলোকে এসব অন্যায়-অপরাধের প্রতিবাদ করা এবং তা নির্মূলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা ঈমান ও ইসলামের অপরিহার্য দাবি।

আবু সায়িদ খুদরি রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে কেউ কোনো অন্যায় হতে দেখলে যেন হাত দিয়ে তা প্রতিহত করে। যদি তা না পারে, তবে কথা দিয়ে; তাও না পারলে অন্তর দিয়ে (ঘৃণা করবে)। এটি ঈমানের দুর্বলতম স্তর।’ (মুসলিম, হাদিস, ৭৪)

আরেক হাদিসে হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘যার হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ করে বলছি, ‘তোমরা অবশ্যই ভালো কাজে মানুষকে আদেশ দেবে এবং অবশ্যই অন্যায় থেকে নিষেধ করবে। যদি তা না করো তা হলে আল্লাহ তোমাদের ওপর তার পক্ষ থেকে শাস্তি প্রেরণ করবেন। এরপর তোমরা তার নিকট প্রার্থনা করলেও তিনি কবুল করবেন না’ (তিরমিজি, হাদিস, ৪০৬)।

অন্যায় ও অত্যাচারের প্রতিবাদ না করলে আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ধ্বংস অনিবার্য। এক হাদিসে নুমান ইবনে বাশির রাদিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যারা মহান আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং যারা সীমা লঙ্ঘন করে, তাদের দৃষ্টান্ত সেই যাত্রীদলের মতো, যারা লটারির মাধ্যমে দ্বিতল বিশিষ্ট এক জাহাজে নিজেদের স্থান নির্ধারণ করে নিল। তাদের কেউ স্থান পেল ওপর তলায় আর কেউ নিচ তলায়। আর পানির ব্যবস্থা ছিল ওপর তলায়। কাজেই নিচের তলার লোকেরা পানি সংগ্রহকালে ওপর তলার লোকদের ডিঙিয়ে যেত। তখন নিচ তলার লোকেরা বলল, ওপর তলার লোকদের কষ্ট না দিয়ে আমরা যদি নিজেদের অংশে একটি ছিদ্র করে নিই তবে ভালো হয়। এমতাবস্থায় ওপর তলার লোকেরা যদি তাদের আপন মর্জির ওপর ছেড়ে দেয় তা হলে সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যদি তারা এদের হাত ধরে রাখে (বিরত রাখে) তবে তারা এবং সবাই রক্ষা পাবে।’ (বুখারি, হাদিস, ২৪৯৩)

যারা অন্যায় দেখেও তার প্রতিহত করার কোন চেষ্টা ফিকির করে না তারা কালিমায়ে তাওহীদের হকের অবমাননা করে। তারা সারা জীবন এ কালিমা পাঠ করলেও তা তাদেরকে আল্লাহর আজাব থেকে বাঁচাতে যথেষ্ঠ হবে না। হযরত আনাস (রা) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন, কালিমায়ে তাওহীদ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ তার পাঠকারীকে সর্বদা উপকার করতে থাকে এবং তার উপর হতে আজাব ও বালা-মুসিবত দুর করতে থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত এর হকের অবমাননা না করা হয়। সাহাবীগণ (রা) জিজ্ঞাসা করলেন, কালিমায়ে তাওহীদের হকের অবমাননা করার অর্থ কি? রাসুলুল্লাহ (সা) বললেন, প্রকাশ্যে আল্লাহর নাফরমানী করা হয় আর তা বন্ধ করার জন্য কোন চেষ্টা করা হয় না। (তারগীব)

অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও যারা অন্যায় কাজে বাঁধা দেয় না তাদের জন্য পরকালের কঠিন শাস্তি ছাড়াও এ দুনিয়াতেও আল্লাহর আজাবে পাকড়াও হবে এ সম্পর্কে হযরত জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেছেন, যদি কোন কোন কওমের মধ্যে কোন ব্যক্তি কোন গোনাহের কাজে লিপ্ত হয় এবং ঐ কওমের মধ্যে শক্তি থাকা সত্ত্বেও তাকে উক্ত গোনাহ থেকে বাঁধা না দেয় তবে মৃত্যুর পুর্বে দুনিয়াতেই তাদের উপর আল্লাহর আজাব নাযিল হয়। (আবু দাউদ, ইবনে মাজা, ইবনে হিব্বান।)

অন্যায়ের প্রতিবাদ না করার ফলে যখন শাস্তি নাযিল হবে তখন দোয়া করলেও সে শাস্তি থেকে বাঁচার কোন পথ নেই। এ সম্পর্কে হযরত হুযাইফা (রা) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “যার হাতে আমার প্রাণ তার কসম করে বলছি, তোমরা অবশ্যই সৎকাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজে বাধা দিবে। তা না হলে অচিরেই আল্লাহর পক্ষ হতে তোমাদের ওপর কঠিন শাস্তি নেমে আসবে। তখন তোমরা (সে শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য) দোয়া করবে, কিন্তু আল্লাহ তোমাদের দোয়া কবুল করবেন না। (তিরমিযী)

প্রকৃতপক্ষে চুরি করার সময় চোরের মাঝে তার ঈমানী শক্তি থাকে না। যার কারণে পাপ সত্তে¡ও একজন চোর তার চুরির কাজ সম্পন্ন করে। হাদিসে এ সম্পর্কে বর্ণনা রয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেছেন, যিনাকারী যখন যিনা করে তখন আর সে ঈমানদার থাকে না। চোর যখন চুরি করে তখন সে ঈমানদার থাকে না। মদ্যপ যখন মদ পান করে তখন তার আর ঈমান থাকে না। যখন ডাকাত এভাবে ডাকাতি করে যে, যখন চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে তখন তার ঈমান থাকে না। এভাবে কেউ যখন গনিমতের সম্পদ খেয়ানত করে, তখন তার ঈমান থাকে না। অতএব সাবধান (এসব গুনাহ হতে দূরে থাকবে)।’ (বুখারি : ২৪৭৫; মুসলিম: ৫৭; আবু দাউদ : ৪৬৮৯; নাসায়ি : ৪৮৭০; তিরমিজি : ২৬২৫; ইবনে মাজাহ : ৩৯৩৬)

প্রিয় নবী (সা.) চোরকে বা চুরিকে কখনও প্রশ্রয় দেননি। চোরকে শরিয়ত মোতাবেক শাস্তি প্রদান করেছেন। মহান রাব্বুল আলামিন চুরির শাস্তি পবিত্র কোরআনে আলোকপাত করেছেন। আল্লাহর বাণীÑ ‘তোমরা পুরুষ চোর এবং মহিলা চোর উভয়ের হাত কেটে দাও। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের কৃতকর্মের শাস্তি স্বরূপ।’ (সুরা মায়িদা : ৩৮)

রাসুল (সা.) অন্যের সম্পদকে লুট করে নেওয়া বা তাতে হস্তক্ষেপ করতে নিষেধ করেছেন। বিদায় হজের ভাষণে তিনি বলেছেন, ‘প্রত্যেক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমানের রক্ত, সম্পদ ও সম্মানে হস্তক্ষেপ করা নিষিদ্ধ।’ (মুসনাদে আহমদ : ১৬০১৯)। তাই চুরি করে হোক আর যেভাবেই হোক অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রহণ করা, ভোগ করা জায়েজ নয়।

ডাকাতি, ছিনতাই, লুট ইত্যাদি চুরি অপেক্ষা আরও গুরুতর অপরাধ। কেননা, চুরি হয় গোপনে, লোক চক্ষুর অন্তরালে। আর ডাকাতি, ছিনতাই, লুটপাট হয় প্রকাশ্যে, জনসমক্ষে বা অস্ত্র ঠেকিয়ে। এটি জঘন্যতম অপরাধ। যার কারণে আল্লাহ তায়ালা এর কঠিন শাস্তি নির্ধারণ করে রেখেছেন। আল্লাহর বাণী, ‘যারা আল্লাহ ও তার রাসুলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ায়, তাদের শাস্তি এই যে, তাদেরকে হত্যা করা হবে অথবা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে অথবা বিপরীত দিক হতে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে অথবা তাদেরকে দেশ হতে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়াতে এটাই তাদের লাঞ্ছনা ও পরকালে তাদের জন্য মহাশাস্তি রয়েছে।’ (সুরা মায়িদা : ৩৩)। এই আয়াতে দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করে বেড়ানোর অর্থ কারও সম্পদ নিয়ে যাওয়া ও হত্যার মাধ্যমে অরাজকতা সৃষ্টি করা। এখানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ডাকাতি, ছিনতাই ও অন্যভাবে বিপর্যয় সৃষ্টিকারীর জন্য সতর্কবাণী প্রদান করেছেন।

জাহিলদের দীনের অন্তর্ভুক্ত বিষয় হলো একজনের অপরাধে আরেকজনকে শাস্তি দেয়া। আল্লাহ তা‘আলা এ প্রসঙ্গে বলেন,

وَلا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى

কোন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না (সূরা ফাতির ৩৫:১৮)।

…………………………………

ব্যাখ্যা: জাহিলী সমস্যা হলো তারা নিরপরাধকে পাঁকড়াও করতো অর্থাৎ অপরের অন্যায়ের কারণে তাকে শাস্তি দিতো। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে বলেন,

(وَلا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى) [فاطر: 18]

কোন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না (সূরা ফাতির ৩৫:১৮)।

সুতরাং যে অন্যায় করেনি তাকে অন্যের অপরাধের কারণে শাস্তি দেয়া যাবে না। যদিও সে অপরাধী ভাতিজা অথবা পিতা অথবা সন্তান হয়। অপরাধীকেই শাস্তি দেয়া হবে। নিরীহকে সীমালঙ্ঘনকারীর অপরাধের কারণে শাস্তি দেয়া যাবে না। সীমালঙ্ঘনকারীর অন্যায়ের কারণে নিরপরাধকে শাস্তি দেয়া হলে তা হবে যুলুম ও অত্যাচার যা ইসলাম স্বীকৃতি দেয় না।

বর্তমানে কতিপয় গ্রাম্যলোকের অবস্থা: অন্য গোত্রের কোন সাধারণ লোকের সাথে নিজ গোত্রের কারো দ্বন্দ্ব হলে গ্রাম্যলোকেরা ঐ সাধারণ লোকের নিকট থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করে না। বরং তাদের গোত্রের অধিক মর্যাদা সম্পন্ন ও সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ হতে প্রতিশোধ গ্রহণ করে অথবা হত্যা করে। তারা সীমা লঙ্ঘনকারীকে শাস্তি দেয় না। বরং তারা কেবল গোত্রের সম্মানিত অথবা গ্রহণযোগ্য অথবা পদ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিকে শাস্তি দেয় যা জাহিলী কর্ম। অন্যায়ের অপরাধীকেই শাস্তির জন্য নির্দিষ্ট করা ওয়াজীব। তার নিকট থেকেই অপরাধের প্রতিশোধ নিতে হবে। এটাই ন্যায় বিচার। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

فَمَنِ اعْتَدَى عَلَيْكُمْ فَاعْتَدُوا عَلَيْهِ بِمِثْلِ مَا اعْتَدَى عَلَيْكُمْ

সুতরাং যে তোমাদের উপর আক্রমণ করেছে, তোমরা তার উপর আক্রমণ কর, যেরূপ সে তোমাদের উপর আক্রমণ করেছে (সূরা আল-বাক্বারাহ ২:১৯৪)।

মোদ্দা কথা: সবচেয়ে বড় মূলনীতি হলো অপরাধীর সাথেই অপরাধকে নির্দিষ্ট করতে হবে, অন্যের সাথে নয়। যদি বলা হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা ভুলের ধার্য্যকৃত ক্ষতিপূরণ নিহতের রক্তমূল্য পরিশোধকারীর উপর নির্ধারণ করেছেন। হত্যাকারীর উপর নির্ধারণ করেননি। তাহলে এ ক্ষেত্রে অন্যের পাপ আরেকজন কি বহন করে না?

জবাবে বলা হবে, এটাই ন্যায় বিচার ও সত্যের সহযোগিতা। কেননা, এটা হত্যাকারীর অনিচ্ছাকৃত ভুল। এখানে ব্যক্তিকে সাহায্যে করাই যথাযথ। মানুষ মারা গেলে আত্মীয়-স্বজনরা যেমন মৃতের সম্পদের ওয়ারীস হয়, এটিও তেমনই। অনিচ্ছাকৃত যে ভুল হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ তার পক্ষ থেকে বহন করবে। অপর দিকে ইচ্ছাকৃতভাবে অন্যায়কারীর উপরই তার অন্যায়ের শাস্তি বা ক্ষতিপূরণ বর্তাবে। একারণে ক্ষতিপূরণ করতে ইচ্ছুকের উপর তা বর্তাবে না।